হেলেন, যাকে আমরা ট্রয় এর হেলেন হিসেবেই বেশি চিনি, গ্রিক ও রোমান পুরান অনুযায়ী তিনি ছিলেন মর্তের সেরা সুন্দরি। তবে তার সৌন্দর্য এতটাই সর্বগ্রাসী ছিল যে ইতিহাসের অনেক উপকরন সৃষ্টি করে দিয়েছে। কিছু কিছু রূপবতী রমণী এতটা রূপবতী না হলে হয়তো পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো।
হেলেন এর খোজ প্রথম পাওয়া যায় মহাকবি হোমার এর মহাকাব্য ইলিয়াড ও অডিসি তে। গ্রিক পুরান মতে হেলেন হলেন দেবতাদের রাজা জিউস এর সন্তান। হেলেন সেই সময়ের মিথ যখন যেকোনো বিষয় কেই দেবতাদের সাথে সংজুক্ত করা হতো। যেমন করা হয়েছে হেলেন এর বেলায়। পুরান অনুযায়ী স্পারটান রাজা টিনডেরিয়াস এর স্ত্রী লিডা ও জিউসের অবৈধ সম্পর্কের ফসল এই প্রচণ্ড সুন্দরি হেলেন। জিউস রাজহাঁস সেজে আসেন এবং মিলিত হন লিডার সাথে। মিথ যাদের ভালো লাগে এবং মিথ নিয়ে যারা একটু ঘাটাঘাটি করে থাকেন তারা জেনে থাকবেন জিউস দেবতাদের রাজা হলেও মর্তে তার সন্তানের অভাব নেই।
হেলেন যখন বড় হতে থাকেন তার সৌন্দর্যের মহিমা চারিদিকে ছরিয়ে পড়তে থাকে। আকর্ষিত হতে থাকে প্রচুর পুরুষ। আর এ আকর্ষণে থেসিয়াস অপহরন করে হেলেন কে পুরান মতে যখন হেলেন এর বয়স মাত্র দশ। থেসিয়াস ও পিরিথাস ছিলেন এথেন্স এর দুই দেবপুত্র। দেবতার পুত্র হওায় তারা দুজন চিন্তা করেন তাদের স্বর্গীয় স্ত্রী দরকার। আর তাই থেসিয়াস পছন্দ করে হেলেন কে আর পিরিথাস পছন্দ করেন হাডেস এর স্ত্রী পারসিফন কে। হেলেন এবং পারসিফন দুজনেই জিউস এর কন্যা। থেসিয়াস ও পিরিথাস একে অপরকে নিজেদের লক্ষ্য পুরনের জন্য সাহায্য করেন। প্রথমে তারা অপহরন করেন হেলেন কে। এরপর হেলেন কে থেসিয়াস এর মায়ের কাছে রেখে তারা যান পারসিফন কে অপহরন করতে। এদিকে পারসিফন এর স্বামী হাডেস বুঝতে পেরে থেসিয়াস ও পিরিথাস কে আমন্ত্রন জানান এবং তাদের সম্মানে এক ভোজের আয়জন করেন। যখনই থেসিয়াস ও পিরিথাস খেতে বসেন তখনি অনেক সাপ এসে তাদের পায়ে জরিয়ে যায় এবং তাদের আটকে ফেলে। আর এদিকে এই সুযোগে হেলেন এর দুই ভাই কাস্টর ও পল্লাক্স তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
হেলেন কে অপহরন করছে থেসিয়াস। |
এরপর রাজা টিনডেরিয়াস যখন হেলেন এর বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন নানান জায়গা থেকে অনেক রাজা, রাজপুত্র হেলেন এর পানিপ্রার্থী হন। মাইসেনিয়ান স্পারটা এর রাজা মেনেলাস তাদের মধ্যে অন্নতম। যদিয়ও তিনি সরাসরি উপস্থিত না হয়ে তার ভাই আগামেনন কে পাঠান। আগামেনন ছিল মাইসেনিয়া এর রাজা। হেলেন এর পিতা মেনেলাস কে তার কন্যার জন্য নির্বাচিত করেন। মেনেলাস এর সাথে বিয়ে হয় হেলেন এর। মেনেলাস হেলেন এর চাইতে ৪০ বছরে বড় হওায় হেলেন কখনোই ভালবাসতে পারেনি মেনেলাস কে। কিন্তু মেনেলাস প্রচণ্ড ভালবাসতেন হেলেন কে। এজন্য হেলেন বেশিরভাগ সময় ই উদাসীন থাকতেন। মেনেলাস সবসময় চেষ্টা করতেন হেলেন কে হাসিখুসি রাখার।
এভাবে চলতে থাকে তাদের জীবন।এমন সময় ব্যাবসা করার জন্য ট্রয় (বর্তমান তুরস্ক) এর রাজপুত্র হেক্টর ও প্যারিস আসেন স্পারটায়। ট্রয় ও স্পারটা ছিল পাশাপাশি দুটো দেশ। মাঝখানে ছিল আজিয়ান সমুদ্র।
স্পার্টার রাজা মেনিলাস প্যারিস ও হেক্টরকে সাদরে আমন্ত্রন জানায়। তাদের আগমনে রাজ্যকে চমৎকারভাবে সাজানো হয়। নৈশভোজের
বিপুল আয়োজন করে প্যারিস ও হেক্টরকে সবার সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেন রাজা
মেনিলাস। এক পর্যায়ে হেলেনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ট্রয় এর রাজপুত্র প্যারিসের।
ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য স্পার্টায় বিশদিন থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে প্যাসিস ও
হেক্টরের। হেক্টর ও মেনিলাস সবসময় ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসা-বাণিজ্যের চুক্তি
নিয়ে। আর এদিকে গোপনে প্যারিস দেখা করতেন হেলেনের সঙ্গে।
প্যারিসের চেহারা, গায়ের গড়ন, শরীর কাঠামো সবকিছুই হেলেনকে বিমোহিত করে,
প্রথমে রাজি না থাকলেও আস্তে আস্তে প্যারিসের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে
পড়েন হেলেন।
হেলেন ও প্যারিস |
অবশেষে সময় হয়ে যায় হেক্টর ও প্যারিস এর ট্রয়ে ফিরে যাবার। তাদের বিদায়
উপলক্ষে রাজা মেনিলাসের নৈশ ভোজের আয়োজন করেন মহা সমারোহে। ভোর হলেই তারা
রওনা দেবেন ট্রয়ের উদ্দেশে। রাজা মেনিলাসের
আপ্যায়নের কোনো কমতি নেই। খাবার-দাবার আর সুন্দরী রমনীদের নাচের দৃশ্য
সাজিয়েছে শেষ নৈশভোজ। নর-নারী, প্রহরী ও হেক্টর, রাজা ও ট্রয়ের অতিথিরা
যখন আমোদ-প্রমোদ আর নাচ-গান নিয়ে ব্যস্ত তখন প্যারিস গোপনে চুপিসারে যান
হেলেনের ঘরে।হেলেন কে নিয়ে আসেন ও লুকিয়ে রাখেন জাহাজে। এজিয়ান সাগরের
মাঝপথে এসে প্যারিস হেক্টরকে
বলেন, হেলেন তাদের সঙ্গে এসেছেন। প্যারিসের কথা শুনে অবাক হয়ে যান হেক্টর!
রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে চটে যায় প্যারিসের ওপর। নাবিকদের বলে জাহাজ
স্পার্টার দিকে ঘুরাতে। কিন্তু প্যারিসের অনুরোধে আর ক্রন্দনে হেক্টর
নিজের মত পরিবর্তন করেন।
এদিকে স্পার্টার রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে প্যারিস হেলেনকে অপহরণ করে ট্রয়ে নিয়ে
গেছে। মেনিলাস পাগলের মতো হয়ে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান আপন ভাই আর্পসের
রাজা আগামেননের। আগামেনন গ্রিসের সম্মান ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রিসের সব
রাজাকে অনুরোধ জানান। প্রায় ১ হাজার জাহাজ নিয়ে ট্রয়ের উদ্দেশে রওনা দেয়
গ্রিসবাসী।
পলায়নরত প্যারিস ও হেলেন |
এদিকে ট্রয় এ সুখে শান্তিতে দিন কাটছিল হেলেন ও প্যারিস এর। ট্রয় নগরিতে উৎসবের ঘটা পরে যায় হেলেন এর আগমন উপলক্ষে। কিন্তু এ আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হোলও না। কিছুদিনের মদ্ধেই ট্রয় এর আকাশে ঘনিয়ে এলো বিপদের কালো মেঘ। হেক্টর ও তার পিতা দেখতে পান হাজার হাজার জাহাজ নিয়ে গ্রিকরা ধেয়ে আসছে ট্রয়ের দিকে। হঠাৎ রাজ্যময় বিপদ ঘণ্টা বাজতে থাকে। রাজ্যের প্রজারা-বিপদ সংকেতে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। ভয় পেয়ে যায় হেলেন। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে চান ট্রয় থেকে। কিন্তু ধরা পরে যান হেক্টর এর হাতে। হেক্টর তাকে সাহস যোগালে হেলেন থেকে যায়।
জাহাজ থেকে সর্বপ্রথম নামেন গ্রিকবীর একলিস। নেমেই যুদ্ধ শুরু করেন একলিস ও
তার সঙ্গীরা। প্রথম যুদ্ধেই ট্রয়নগরীর বন্দর দখল করেন নেয় গ্রিকরা। এভাবে
টানা ১০ বছর বন্দর ও রাজ্য অবরোধ করে রাখে গ্রিকরা। বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে
নিহত হয় একলিসের ভাই উইরোরাস, প্যারিসের বড় ভাই ট্রয়বীর হেক্টর ও নাম না
জানা উভয়পক্ষের হাজারও যোদ্ধা। যুদ্ধে সহজে জয়লাভ না করতে পেরে গ্রিকরা
প্রতারণার আশ্রয় নেয়। তৈরি করে বিশাল আকৃতির ঘোড়া। যার নাম ট্রোজেন হর্স।
ঘোড়ার মধ্যে লুকিয়ে রাখে শত শত সৈন্য। উপহার হিসেবে পাঠায় ট্রয় রাজার
কাছে। রাজ্যের বাইরে লুকিয়ে থাকে গ্রিকরা কিন্তু এসবই অজানা থাকে
ট্রয়বাসীর কাছে।
গ্রীকদের ট্রয় নগরিতে পাঠানো ট্রোজান হর্স। |
মহা-আনন্দে আর উৎসাহে ঘোড়াটিকে রাজ্যের ভেতরে নেয় ট্রয়বাসী। কিন্তু বিধি
বাম, গভীর রাতে ঘোড়া থেকে বের হয়ে ট্রয়বাসীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়
গ্রিকরা। গ্রিক সৈন্যরা ট্রয় রাজ্যে ধরিয়ে দেয় আগুন। মুহূর্তের মধ্যে দাউ
দাউ করে জ্বলতে থাকে ট্রয় নগর। আগুনে পুড়ে হাজার হাজার সৈন্য আর নিরীহ
নাগরিক মারা যায়। একলিস ছুটে যায় হেলেনকে বাঁচানোর আশায়; কিন্তু
প্যারিস তীর বিদ্ধ করে মেরে ফেলে একলিসকে।
এদিকে এক পর্যায়ে প্যারিস ও মাড়া যায়। একসময় শেষ হয় যুদ্ধ। মেনিলাস ফিরে চলে হেলেন কে নিয়ে। কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর ধরে চলা এ যুদ্ধ তছনছ করে দিয়েছিল ট্রয় নগরীকে। কিন্তু এই যে এত যুদ্ধ এক হেলেন কে নিয়ে। কেও কি সুখী হতে পেরছিল হেলেন কে নিয়ে? তাই হেলেন কে নিয়ে শোকগাথা লেখা হয়েছে প্রচুর। তৈরি হয়েছে প্রচুর নাটক সিনেমা। যারা হেলেন বিষয়ে আগ্রহী তারা হেলেন মুভিটি দেখে নিতে পারেন।
তথ্য সুত্রঃ
১. http://en.wikipedia.org/wiki/Helen_of_Troy
২. http://ancienthistory.about.com/cs/troyilium/a/helenoftroybasc.htm
৩. http://www.stanford.edu/~plomio/history.html
৪. The movi "Troy" directed by Wolfgang Petersen.
বি. দ্রঃ সকল ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।
আপনার ব্লগ এ আমি নিয়মিত হয়ে যাচ্ছি। অসাধারন লাগে যখন পড়ি। আপনি কষ্ট করে আমাদের জন্য তথ্য দেন। আপনের কষ্ট আমাদের জন্য জ্ঞান সরুপ। ধন্যবাদ আপনাকে।
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ Fardous Tusher সাথে থাকার জন্য। আশা করি আরও ভালো কিছু দিতে পারব।
উত্তরমুছুনভালো থাকবেন।
valo thank u
উত্তরমুছুন