মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০১৪

ছোটগল্পঃ বাতাসে কাঁঠালচাঁপার সুবাস!

"তারপর কি হলো মতিন ভাই?"

ধোয়া ওঠা সিরামিকের চায়ের কাপে সশব্দ একটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলো মতিন। বেশ আয়েশি একটা ভঙ্গি তার। শীতের রাত। বিদ্যুৎহীন একটা গ্রামে যেখানে সূর্যাস্ত মানেই রাত সেখানে রাত দশটায় নদীর পাড়ে বসে চা খাওয়া বিলাসিতাই বলা চলে। মতিনের বাড়ি বেশ ছিমছাম, গ্রামের শেষ প্রান্তে। বাড়ির একেবারে পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। পূর্ণিমার আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হয়ে অপার্থিব এক আবহ সৃষ্টি করেছে। সুমন আর পলাশ একটু আগেও হাঁ করে এই সৌন্দর্য গিলছিল। কিন্তু এখন তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এই সৌন্দর্যে। তাদের সমগ্র সত্তা উশখুশ করছে মতিন এর গল্প শোনার জন্যে।

সুমন, মতিনের চাচাতো ভাই। শহুরে ছেলে। গ্রামে খুব একটা আসে নি এর আগে। হঠাৎ কলেজে গ্যাঞ্জাম হওয়ায় অনাকাঙ্খিত একটা লম্বা ছুটি পেয়ে গেছে। তাই বন্ধু পলাশ কে নিয়ে চলে এসেছে গ্রামে মতিন এর কাছে। মতিনের স্ত্রী মাস চারেক হলো মাড়া গেছে। একা একাই থাকে মতিন। সুমন আর পলাশ আসায় সেও ভীষণ খুশি হয়েছে। সারাদিন ওদের নিয়ে বেশ কেটে গেছে মতিনের। পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরা, সেই মাছ রান্না করা, দুপুরে খাবার পড় গাছতলায় পাটি বিছিয়ে আয়েশি মধ্যাহ্ন নিদ্রা, বিকেলে ওদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে যেয়ে দিন কখন শেষ হয়ে গেছে টের পায়নি মতিন।

রাতের খাবার পড় মতিন তার অসাধারণ চা বানিয়ে সুমন আর পলাশ কে নিয়ে নদীর পাড়ে বসেছে গল্প করতে। মতিন বেশ সৌখিন মানুষ। নদীর পাড়ে বেশ সুন্দর বসার ব্যাবস্থা করেছে সে মোটা গাছের গুড়ি ফেলে।

"রুপা (মতিনের স্ত্রী) বেঁচে থাকতে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা এখানে বসে থাকতাম।" মতিন আবার বলা শুরু করেছে। সুমন আর পলাশ পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে মতিনের দিকে। চাঁদের আলোয় মতিন কে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। সুমন আর পলাশ চোখ ফেরাতে পারছে না।

"তোদের ভাবির একটা উদ্ভট সখ ছিল। প্রতিদিন একটা করে কাঁঠালচাঁপা ফুল এনে দিতে হতো। সে রাতে কাঁঠালচাঁপা ফুল হাতে নিয়ে এখানে বসে থাকতো আর কিছুক্ষন পর পর বুক ভরে ফুলের ঘ্রান নিতো।" আবার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল মতিন।

সুমন আর পলাশ ভেতরে ভেতরে উশখুশ করলেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিছু বলতে পারছিল না। বেশ কিছুক্ষন পর খুক করে একটা কাশি দিলো সুমন। সম্বিৎ ফিরে পেল মতিন।

"ওহ হ্যা, যা বলছিলাম। হঠাৎ একদিন রাতে খুব জ্বর এলো রুপার। রাত যতো বাড়তে থাকলো জ্বর ও সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়তে থাকলো। সারারাত বসে মাথায় পানি দিলাম, পানি পট্টি দিলাম। জ্বর আর কমলো না। ভোর এর দিকে রুপা আমার হাত চেপে ধরলো। বলে আমাকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারবা না? আমি বললাম এই যে রুপা দেখো আমি তোমাকে ধরেই আছি। ও বললো আরও শক্ত করে ধরো। নাহলে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি হতবাক হয়ে রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ভাবলাম বুঝি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। কিন্তু রুপার চোখ দুটো যেন কিছু বলতে চাচ্ছিল আমাকে। কেমন একটা ব্যাকুলতা ছিল ওর চোখে। একটা কিছু না বলা কথা খেলা করছিল ওর নিস্প্রান চোখে যা ও প্রকাশ করে যেতে পাড়েনি। আজ ও আমি বুঝতে পারলাম না কি বলতে চেয়েছিল রুপা। একটা রাতের জ্বর এভাবে একটা মানুষ কে কেড়ে নিয়ে যায়? আমি কেন আরেকটু জোরে ওর হাত চেপে ধরে থাকলাম না।" একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মতিন এর ভেতর থেকে।

সুমন বা পলাশ কেউ ই মতিন কে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা খুজে পাচ্ছিল না। কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে সুমন বললো-
"চলো মতিন ভাই, ঘরে যাই।"
"তোরা যা। আমি কিছুক্ষন পরে আসছি। এখানে বসে থাকলে কেন যেন আমার মনে হয় রুপা আমার পাশেই আছে।"

আর কিছু বললো না ওরা। উঠে দাঁড়ালো ঘরে যাবার জন্য। হঠাৎ তাদের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেলো। বাতাসে কাঁঠালচাঁপার সুবাস!


বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০১৪

ময়ূর এর লেজে এতো চোখের ন্যায় কারুকার্য কোথা হতে এলো?


         

গ্রীক মিথ অনুযায়ী, দেবতা ইনাকাস এর কন্যা ছিল রাজকন্যা আইও। দেবরাজ জিউস এর নারিলিপ্সা এর ব্যাপারটা যারা একটু আধটু মিথ পরেছেন তাদের কাছে অজানা কিছু না। মিথ ঘাঁটলেই অনেক নজির পাওয়া যায়। তো অনেকের মতো রাজকন্যা আইও এর ও প্রেমে পড়ে যান জিউস। প্রতি রাতে স্বপ্নে প্ররোচিত করতে থাকেন আইও কে। কিন্তু বাধা হিসেবে চলে আসেন জিউস এর স্ত্রী হেরা। হেরা ছিলেন প্রচণ্ড ঈর্ষাপরায়ণ। এ ব্যাপারে পড়ে কখনো বলা যাবে। তো হেরার চোখ এড়িয়ে আইও এর কাছে যাওয়ার বুদ্ধি করতে লাগেন দেবরাজ জিউস। একদিন জিউস পুরো পৃথিবীকে কালো মেঘে আচ্ছ্যন্ন করে চলে এলেন আইও’র কাছে। কিন্তু হেরা ও চতুর কম না। হঠাৎ পৃথিবীর প্রকৃতির এই পরিবর্তন এ সন্দেহ যাগে হেরার মনে। হেরা স্বর্গের কোথাও জিউস কে না পেয়ে নেমে আসেন পৃথিবীতে। হেরার হাতে ধরা খাওয়ার ভয়ে জিউস আইও কে বকনা বাছুর বানিয়ে দেন যাতে হেরা বুঝতে না পারে এটা আইও। কিন্তু হেরা ও কম যায় না। বুঝে ফেললো সব। জিউস কে বলল- “এই বকনা বাছুরটি খুব ই সুন্দর। তুমি কি এর কোনও অংশ আমাকে উপহার দেবে?”

বাধ্য হয়ে জিউস আইও কে হেরার হাতে তুলে দিলেন। এবার হেরা বকনা বাছুরটির পাহারার জন্য নিয়োগ দিলেন দেবতা আরগাস পানোপটেস কে যিনি ছিলেন হেরার প্রিয়ভাজন। আরগাস পানোপটেস এর ছিল একশত চোখ। আরগাস এর সবগুলো চোখ কখনো একসাথে ঘুমাতো না।

এবার জিউস বুদ্ধি করতে লাগলো কিভাবে আরগাস পানোপটেস এর হাত থেকে মুক্ত করা যায় আইও কে। তিনি শরণাপন্ন হলেন সুচতুর দেবতা হার্মিস এর। তিনি হার্মিস কে সব বুঝিয়ে বলার পর হার্মিস নেমে গেলেন আরগাস এর কবল থেকে আইও কে উদ্ধারের অভিযানে। হার্মিস রাখালের বেশে পৃথিবীতে এসে সুমধুর সুরে বাশি বাজাতে বাজাতে আরগাস এর কাছে গেলেন। হার্মিস এর বাশির সুরে আরগাস বিমহিত হয়ে হার্মিস কে কাছে ডাকেন। হার্মিস বাশিতে বিভিন্ন সুর শুনিয়ে আরগাস কে ঘুম পড়ানোর চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু আরগাস এর কোনও না কোনও চোখ খোলা থাকেই। এরপর হার্মিস, আরগাস কে দেবতাদের কাহিনি শোনাতে শুরু করলে আরগাস বিরক্ত হয়ে সবগুলো চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। এই সুযোগ এ হার্মিস হত্যা করে আরগাস কে। এবং উদ্ধার করে নিয়ে আসেন আইও কে। তখন হেরা আরগাস এর চোখ গুলো নিয়ে তার প্রিয় পাখি ময়ূর এর লেজে লাগিয়ে দেন। আর এভাবেই ময়ূর এর লেজে এতো চোখের ন্যায় কারুকার্য।

বি.দ্রঃ এই আইও এর বংশধর হল আমাদের অতিপরিচিত হারকিউলিস।