সোমবার, ২২ জুলাই, ২০১৩

ক্লিওপেট্রা- সৌন্দর্যের রানী।

 নারী হেসে ওঠার আগে 
পৃথিবী ছিল বিষণ্ণ
বাগান ছিল জঙ্গল
আর পুরুষ ছিল সন্ন্যাসী।।

শতাব্দীর পর শতাব্দী সৌন্দর্য পুজারিদের অন্যতম উপাসনা যেই নারীকে নিয়ে, যার সৌন্দর্যের মায়াজালে আটকা পরেছে অনেক বাঘা বাঘা মানুষ সে আর কেও না, রানী ক্লিওপেট্রা। এই একটি মহিলাকে নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে অনেক বড় বড় সাহিত্যিক লিখে চলেছেন নানান উপাখ্যান। কেও লিখেছেন উপন্যাস, কেও গল্প, কেও কবিতা আবার কেও বা অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এই তালিকায় যেমন আছে সেক্সপিয়ার, জর্জ বার্নড শ, হেনরি রাইডার হ্যাঁগারড এর মতো মহামহিম সাহিত্যিক, তেমনি আছে ড্রাইডেন প্লুটার্ক, ড্যানিয়েল সহ আরও অনেক সাহিত্যিক। এদের সবাই ক্লিওপেট্রার চারিত্রিক বিভিন্ন রুপ নিয়ে লিখেছেন তাদের উপাখ্যান, তবে সবাই চেষ্টা করেছেন ক্লিওপেট্রার ঐতিহাসিক অবস্থান যথাযথ রাখার। যেমন সেক্সপিয়ার তার এন্টোনিয়ও ক্লিওপেট্রা উপন্যাসে ধারালো লেখনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন ক্লিওপেট্রার রূপ সেই সাথে তুলে ধরেছেন এন্টোনিয়ও ও ক্লিওপেট্রার রোম্যানটিসিসম। অন্নদিকে জর্জ বার্নড শ তার সিজার ক্লিওপেট্রা উপন্যাসে সিজার এবং ক্লিওপেট্রার রোম্যানটিসিসম তুলে ধরেছেন। তবে হেনরি রাইডার হ্যাঁগারড তার উপন্যাস ক্লিওপেট্রা তে অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন ক্লিওপেট্রার ব্যাক্তিত্ব, উচ্চাভিলাস ও কিছুটা নারী সুলভ অসহায়ত্ব। 

 তবে একটা মজার বিষয় হোলও যে ক্লিওপেট্রা নিয়ে এত আলোচনা তার নাম কিন্তু সপ্তম ক্লিওপেট্রা। তার আগেও তাদের বংশেই আরও ছয় জন ক্লিওপেট্রার আবির্ভাব হয়েছিল, কিন্তু তারা কেও ই পাদপ্রদীপ এর আলয় আসতে পারে নি। তাই তাদের নিয়ে আলোচনা ও হয় না। আমাদের এই সপ্তম ক্লিওপেট্রা ছিলেন দ্বাদশ টলেমী ও পঞ্চম ক্লিওপেট্রার সন্তান। তিনি ছিলেন মিশরের মেসিডোনিয়ান সম্রাজ্জের শেষ সম্রাজ্ঞী। আলেকজেন্ডার এর হাত ধরে মিশরে ৩২৩ খ্রি. পূর্বাব্দে যে মেসিডোনিয়ান সম্রাজ্জের গোঁড়া পত্তন হয় তার শেষ হয় এই সপ্তম ক্লিওপেট্রার সময়। 


আলেকজেন্ডার মিশর দখল করার পর তার সেনাপতি প্রথম টলেমী মিশরের দায়িত্ব হাতে নেন এবং মিশরের রাজা নিজুক্ত হন। এরপর প্রায় ৩০০ বছর তিনি ও তার বংশধরেরা এই  মেসিডোনিয়ান সম্রাজ্জের পরিচালনা করেন। সুবর্ণ সময়ে এই এই মেসিডোনিয়া বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর শক্তি ছিল।


খ্রি. পূর্ব ৫১ শতাব্দীতে ক্লিওপেট্রার পিতা দ্বাদশ টলেমী যখন মাড়া যান ক্লিওপেট্রার বয়স তখন মাত্র ১৮ এবং তার ভাই ত্রয়োদশ টলেমীর বয়স মাত্র ১০। এসময় তারা দুই ভাই বোন বিয়ে করে ও দেশ পরিচালনা শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের তারা করতে থাকে। এসময় মিশরের অর্থনীতি একেবারেই ভেঙ্গে পরে। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকে। সাথে আসে ভয়াবহ বন্যা। সেই সাথে ত্রয়োদশ টলেমী ও ক্লিওপেট্রার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। 


এরপর ক্লিওপেট্রা সিরিয়া তে চলে যায় এবং সেখানে নিজস্ব একটি সেনাবাহিনী গঠন করে এবং নিজেকে মুকুটের একমাত্র দাবীদার ঘোষণা করে। মিশরে ফিরে এসে ক্লিওপেট্রা তার ভাই ত্রয়োদশ টলেমী এর সাথে রাজ্যের পূর্বাংশে পেলুসিয়াম নামক স্থানে মুখোমুখি হন। এদিকে তৎকালীন সময়ে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার ও পম্পেই কে খুজতে মিশরে এসে পৌঁছান। কেননা পম্পেই সিজার এর কাছে পরাজিত হয়ে মিশরে পালিয়ে আসেন এবং টলেমীর নির্দেশে খুন হন। তো সিজার মিশরে এসেই ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন এবং ক্লিওপেট্রার বাহিনির সাথে যুক্ত হয়ে টলেমীকে পরাজিত করেন ও ক্লিওপেট্রা কে মিশরের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হিসেবে ঘোষণা করেন।জুলিয়াস সিজার ও ক্লিওপেট্রার একটি পুত্র সন্তান হয় ক্লিওপেট্রা যার নাম রাখেন সিজারিয়ান যার অর্থ ছোট সিজার। যদিও সন্দেহ আছে সিজারিয়ান আদৌ জুলিয়াস সিজার এর সন্তান কিনা? 



ক্লিওপেট্রা সিজার কে তার উত্তরাধিকার দেওয়ার অনুরোধ করে কিন্তু সিজার রাজি হয় না। সিজার অকটভিয়ান কে তার উত্তরাধিকার নির্বাচিত
করেন।খ্রি. পূর্ব ৪০ অব্দে জুলিয়াস সিজার নিহত হন। এরপর রোম শাসন বাবস্থায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় সে সময় হাল ধরেন মার্ক এন্টোনি। এর পর মার্ক এন্টোনি ও ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যের মায়া জালে আবদ্ধ হন। ভালবেশে ফেলেন ক্লিওপেট্রা কে। বিয়ে ও করেন। তারা তিনটি সন্তান জন্ম দেয়।

এ পর্যায়ে এসে কাহিনী খুব ই দুঃখজনক। এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে এন্টোনি কে মিথ্যে খবর দেওয়া হয় যে ক্লিওপেট্রা খুন হয়েছে। প্রচণ্ড দুঃখে এন্টোনি আত্মহত্যা করেন। এই খবর পেয়ে ক্লিওপেট্রা ও আত্মহত্যা করেন নিজের কপালে মিশরীয় গোখরো সাপের ছোবল নিয়ে। যদিও ক্লিওপেট্রার মৃত্যু নিয়ে কিছু সন্দেহ থেকে যায়। অনেকের মতে ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেন নি। তাকে হত্যা করা হয়। হারমেসিস নামক মিসরীয় রাজবংশের এক সদস্য তাকে হত্যা করেন। সে আরেক বিশাল ইতিহাস। হেনরি রাইডার হ্যাঁগারড তার ক্লিওপেট্রা উপন্যাসে এই কাহিনী ফুটিয়ে তুলেছেন। 



ক্লিওপেট্রার জীবন বা সৌন্দর্য শুধু মাত্র ঐতিহাসিকদের বা সাহিত্যিক দের ই আকর্ষণ করে না, সাধারন মানুষকেও আকর্ষণ করে প্রবল ভাবে। অনেক গান, কবিতা রচিত হয়েছে এই ক্লিওপেট্রা কে নিয়ে। হয়েছে বেশ কয়েকটি সিনেমা। যা মধ্যে অন্নতম হোলও এলিজাবেথ টেলর অভিনিত ক্লিওপেট্রা। ক্লিওপেট্রার প্রতি মানুষের আকর্ষণ থাকবে যুগের পর যুগ যতদিন পৃথিবীতে থাকবে সৌন্দর্য পুজারিরা। তাদের উপাসনা চলতেই থাকবে। তাছারা ইতিহাসে ক্লিওপেট্রার অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারী হয়েও তিনি যে বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সাথে দেশ পরিচালনা করে গেছেন তা আসলেই বিস্ময়কর।


তথ্য সুত্রঃ 

১. http://en.wikipedia.org/wiki/Cleopatra
২. http://www.biography.com/people/cleopatra-vii-9250984
৩. সিজার অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা- জর্জ বার্নড শ।
৪. এন্টোনিয়ও অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা- সেক্সপিয়ার।
৫. ক্লিওপেট্রা- হেনরি রাইডার হ্যাঁগারড 

বি.দ্রঃ সকল ছবি গুগল থেকে ধার করা।
 


৫টি মন্তব্য:

  1. যদিও দেখছি ভাই এর blog এ কেউ কমেন্ট করে নি। কেন করল না জানি না। ব্লগ পড়ার পর থেকে আমার খুব ইচ্ছা করল আমি কিছু লিখি। পড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে আজ যদি হুমায়ন আহমেদ থাকতেন স্যার অবশ্যই আপনার লেখার একজন পাঠক হয়ে যেতেন। লেখা গুলো খুবই গোছানো। আসলে এই ইনফর্মেশন আমি কিছুই জানতাম না। আজ বড় ভাল লাগছে এই ভেবে ক্লিওপেট্রা সম্পর্কে আমিও কিছু জানি এই ভেবে। আমি আশা করব ভবিষ্যৎ এও আপনার কাছ থেকে আরও অনেক অজানা তথ্য পাব। আমার পূর্ণ অভিনন্দন রইল।

    উত্তরমুছুন
  2. অনেক কিছুই জানলাম। ধন্যবাদ আপনাকে :)

    উত্তরমুছুন
  3. খুবই তথ্য বহুল লেখা. ভালো লাগলো. ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন
  4. ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠ উপস্থাপনা। এক কথায় অনবদ্য। অনেক ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন